বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অগ্রণী ব্যাংক পরিবার: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ড যাদের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে তাঁরা হচ্ছেন এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান — মুক্তিযোদ্ধাগণ। যতোদিন বাংলার আকাশে সূর্যোদয় হবে ততোদিন বাঙালি জাতি তাঁদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস সংরক্ষণ করার জন্য অগ্রণী ব্যাংক নিল এই বিরল উদ্যোগ। এটা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি অগ্রণী ব্যাংকের সম্মাননা স্মারক। উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম ব্যাংকের জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন স্মৃতি নিয়ে একটি গ্রন্থ সংকলনের জন্য উপ-মহাব্যবস্থাপক আবু হাসান তালুকদারকে নির্দেশনা প্রদান করেন। কর্পোরেট আবহে এ ধরণের সৃজনশীল কাজ করে অভূতপূর্ব ও প্রশংসিত একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।
গত ১৯ আগস্ট নান্দনিক এ গ্রন্থটির মোড়ক উম্মোচন করা হয় জাতীয় যাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনয়াতনে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপি, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্ত্, পরিচালক কাশেম হুমায়ূন ও আনসার আলী খান এবং এমডি এবং সিইও মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম।
বইয়ের বিষয়বস্তু
বইয়ের বিষয়বস্তুতে রয়েছে বাংলাদেশের ইতিবৃত্ত, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ড. জায়েদ বখ্ত্ পরিবার: একাত্তরের অবরুদ্ধ দিনগুলি, মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম : স্মৃতি ৭১ এবং অগ্রণীর ১৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন রোমাঞ্চকর স্মৃতিকথা। এছাড়াও রয়েছে দেশের খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ফটো অ্যালবাম ইত্যাদি। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮১৬ এবং মূল্য ধরা হয়েছে ১,০০০ টাকা।
আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, এমপি
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক,এমপি বলেন, দেশের কোন প্রতিষ্ঠান এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করেছে সেটা আমার জানা নেই। এই প্রতিষ্ঠানের মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য রের্কড করে বিশাল কলেবরে বই প্রকাশ করার উদ্যেগটা প্রশংসনীয়। ব্যক্তিগতভাবে অনেক স্মৃতিচারণ হয়েছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এরকম কোথাও হয়নি। এক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংক পথিকৃৎ হয়ে থাকবে। তাই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরকে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত বোধ করছি। এটা আমারও সম্মান মনে করি।
ডাক্তার মুরাদ হাসান এমপি
বিশেষ অতিথি ডাক্তার মুরাদ হাসান এমপি, মাননীয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে এবং নেতৃত্ব বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা নিয়ে লিখিত এই অসাধারণ উদ্যোগটি অগ্রণী ব্যাংক গ্রহণ করেছে এজন্য অভিনন্দন। এ বইয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের যে স্মৃতিকথা এদেশের মানুষ বিশেষত নতুন প্রজন্ম, যারা আগামী দিনের বাংলাদেশকে গড়বে তাদের জন্য একটি রের্কড, একটি অমূল্য দলিল হয়ে থাকবে।
ড. জায়েদ বখ্ত
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখ্ত বলেন, বাঙালি জাতির জন্য যে কয়টি গর্ব করার বিষয় আছে তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে সবচে’ মূল্যবান সম্পত্তি। আইয়ুব খান তার ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স বইটাতে লিখেছিলেন, বাঙালি যুদ্ধ করতে জানে না। তাই পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালিদের নেয়া হতো না কিংবা খুব কম নেয়া হতো। ’৪৭ থেকে ’৭১ যে বঞ্চনার শিকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিল, সেগুলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছি। কখনো সশস্ত্র সংগ্রামে যাই নাই। কিন্তু যখন তারা আমাদেরকে দাবায়া রাখার চেষ্টা করল, যখন বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট কন্ঠে বললেন, আমাদেরকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না, সেই দিন বাঙালির ইগোটা নড়ে উঠল। এটা আমাদের সম্পদ, এটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। অন্যদিকে আমাদের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, আমাদের স্মৃতি খুব দুর্বল। আমরা আমাদের চেতনাটা ধরে রাখতে পারি না। এজন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রজ্জ্বলিত করে রাখা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে রোমন্থন করা, তাহলে আমাদের ইগোটা নাড়া খাবে, তখন আমাদের চেতনাটা প্রজ্জ্বলিত হবে। এই যে চেতনাকে প্রজ্জ্বলিত রাখতে হবে সেটার প্রথম ধাপে টেক্সটগুলোকে এক জায়গায় আনতে হবে। এই জিনিসটি করার জন্য অগ্রণী ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগটা নেয়া হয়েছে আমি সেটাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা একটা স্টেপ এগিয়ে গেলাম ।
কাশেম হুমায়ূন
ব্যাংকের পরিচালক এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক কাশেম হুমায়ূন বলেন, ব্যাংকের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন যে স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে, আগামী প্রজন্মের জন্য এটা একটা বিরাট ইতিহাস হয়ে থাকবে। বইটি গ্রন্থনা করে অগ্রণী ব্যাংক অত্যন্ত মূল্যবান একটি কাজ করেছে। ব্যাংকের অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা নিয়ে বইটির দ্বিতীয় সংখ্যা দেরি না করে বের করা উচিৎ। কেননা, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বয়স হয়েছে, তাঁরা পরপারে চলে গেলে তাঁদের সাক্ষাৎকার নেয়ার আর সুযোগ থাকবেনা।
মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম বলেন, সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাদের জন্য এই দেশ, যাদের জন্য আজকের এই আয়োজন, তাদের জন্য সামান্যতম একটা কিছু করতে পেরে আমরা সম্মানিতবোধ করছি। আমরা মনে করি আমাদের বইটার সেকেন্ড এডিশন হবে। এটা স্ক্যানিং হবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে এক্সপার্ট নেবো, ইতিহাস বিষয়ক এক্সপার্ট নেবো। এভাবে সব ঘটনা ইতিহাসের দলিল হয়ে যাবে। তাই আমরা দেখবো বইটিতে মনগড়া কিছু আছে কিনা এবং একটা সুন্দর স্ক্যানিং এর মধ্যেই কিন্তু এটা ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। আমরা এগোচ্ছি। আপনারা আমাদের সাপোর্ট দিবেন। আমরা আরো স্মৃতিকথা চাই, রণাঙ্গনের কথা জানতে চাই। নিশ্চয় আমরা এর দ্বিতীয় খন্ড বের করবো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জানতে হবে। তাই আসুন, সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে আপনারা আন্তরিকতা দিয়ে আমাদের সাহায্য করুন। এ বই প্রকাশে আমাদের আন্তরিকতার কোন ত্রুটি নাই। আমরা মনে মনে সর্বশক্তি দিয়েছি যাতে এটাতে কোন ধরণের ভুল না হয়। তারপরও ভুল থাকবেই। আসুন আমরা সবাই মিলে আরও পরিশীলিত, পরিমার্জিত একটা বই প্রকাশ করি।
সুকান্তি বিকাশ সান্যাল
মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানটির সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মহাব্যবস্থাপক সুকান্তি বিকাশ সান্যাল। তিনি মাননীয় অতিথিবৃন্দ এবং সমবেত মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ সহ উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছি। কোন ভুল ত্রুটি থাকলে এর একজন অর্গানাইজার হিসেবে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ‘অগ্রণী ব্যাংক পরিবার: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা’ বইয়ের সংকলক আবু হাসান তালুকদার, প্রকাশক আলাউদ্দিন আল আজাদ। আমন্ত্রিত অগ্রণী ব্যাংকের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাগণের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এ জেড এম সাদেকুর রহমান খান, মো. এনামুল হক, শামসুল হোসেন, মো. হেলাল উদ্দিন, মো. ইদ্রিস আলী মিয়া প্রমুখ।
প্রতিবেদক: এ এইচ এম জহিরুল ইসলাম ।